Advertisement
আগামী ১ বৈশাখ (১৫ এপ্রিল) নববর্ষ উপলক্ষ্যে গৌড়েশ্বর শশাঙ্কদেবের ১৪৩২ তম রাজ্যাভিষেক দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে "বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ"-এর উদ্যোগে কলকাতায় এক বৃহৎ গৌড়ীয় শোভাযাত্রা হতে চলেছে । গৌড়ীয় জাতির জনক, জাতি সংগঠক এবং গৌড় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গৌড়াধিপতি শশাঙ্কদেব, যাঁর রাজ্যাভিষেকের সাথেই ক্রমান্বয়ে একাধিক বিজয়ের ফলে সমগ্র বিশ্বের বুকে গৌড়ীয় জাতি এক মহাশক্তিধর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল, তাঁকে স্মরণ করা আজ প্রতিটি গৌড়সন্তানের দায়বদ্ধতা। পৃথিবীর যে কোনো জাতির উত্থানের ইতিহাসের সরল রূপরেখা হলো একজন পরাক্রমশালী যোদ্ধার নেতৃত্বের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ভূখণ্ড জনপদ একত্রিত হয়ে এক ধর্ম্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এই বৃহৎ জাতীয় রাজ্য নির্মাণ করে । সেই ঐক্যচেতনার অন্তর্গত প্রতিটি ব্যক্তি, পরিবার নিয়ে নির্ম্মিত হয় জাতি । আমাদের বাঙ্গালী জাতির ক্ষেত্রে এই নেতৃত্বের দার্ঢ্য অর্জন করেছিলেন মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেব । তাঁর সফল নেতৃত্বে বরেন্দ্র-রাঢ়-বঙ্গ সম্মিলিত সমগ্র ভূখণ্ড একক গৌড়ীয় নিয়ন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত হয় । গৌড়াধিপ শশাঙ্কের শাসনাধীন গৌড়ীয় জাতির জাতীয় ঐক্যের মাধ্যম ছিল এক গৌড়ীয় ভাষা, তাঁর নামাঙ্কিত গৌড়ীয় স্বর্ণমুদ্রা এবং গৌড়ীয় সংস্কৃতি - গৌড়ীয় রাগসঙ্গীত, গৌড়ীয় নৃত্য, গৌড়ীয় রীতি স্থাপত্য-ভাস্কর্য ইত্যাদি ।
বঙ্গাধিপতি শশাঙ্কদেব বাঙ্গালী জাতির নিজস্ব দিনপঞ্জি “বঙ্গাব্দ” নির্মাণ করেছেন । সূর্য্যসিদ্ধান্ত অনুসারে তাঁর রাজ্যাভিষেকের দিবস (৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) হতেই বঙ্গাব্দের সূচনা, যা আজও আমাদের দৈনিক কালনির্ধারণের মাধ্যম । পরমমাহেশ্বর সম্রাট শশাঙ্কের শাসনে বাঙ্গালী জাতির ধ্রুপদী নৃত্যরীতি ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষনা লাভ করে । শৈবসাংস্কৃতিক ধারায় প্রভাবিত এই নৃত্য প্রাচীন বঙ্গীয় কবিদের দ্বারা গৌড়ীয় সংগীতের রাগ ও তাল অনুসারে রচিত ও সুরাপিত গানের মাধ্যমে ধর্মীয় গল্প প্রকাশ করেছিল । তাঁর শাসনকালে হিউয়েন সাং গৌড় ভ্রমণপূর্বক নিজ বৃত্তান্তে গৌড়ীয়দের মধ্যে ‘মুখোশ পরিহিত নৃত্য’ধারার উল্লেখ করেছেন যা ‘গম্ভীর নৃত্য’ নামে সুখ্যাত।
গৌড়ীয় সঙ্গীতধারার অন্যতম নিদর্শন হলো ‘কীর্ত্তন’, যা বহু প্রাচীনকাল থেকে আমাদের বাঙ্গলা ভাষার কাব্যিক ঐতিহ্য, পারম্পৰ্য্য এবং মাধুর্য্য সংরক্ষণ করে আসছে । পরমনারসিংহ গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেনের রাজসভার ‘নবরত্ন’ মণ্ডলীর অন্যতম প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত জয়দেব রচিত “গীতগোবিন্দম”, কীর্তন গানের প্রকৃত উৎস । পঞ্চদশ শতকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নেতৃত্বে
গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্মের প্লাবন বাঙ্গালী জাতিকে বিধর্মী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করে । মধ্যযুগের অন্ধকার যুগেও ভূরিশ্রেষ্ঠ এবং মল্লভূমের মতো হিন্দুরাজ্যের বাঙ্গালী নৃপতিগণের পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য বাঙ্গলা ভাষাকে বিবিধরূপে সমৃদ্ধ করেছে । গৌড়ীয় কীর্ত্তন সঙ্গীতরীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এক বিশেষ বাদ্যযন্ত্র - ‘শ্রীখোল’ । গৌড়ীয় নগরকীর্ত্তনের সূচনালগ্ন থেকে খোল পরিব্রাজকদের অবিচ্ছিন্ন সঙ্গী থেকেছে ।
নগরকীর্ত্তন তথা পথপরিক্রমা - বাঙ্গালী জাতিকে আধ্যাত্মিকভাবে সংগঠিত করতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই ঐক্যের চেতনাকে অস্ত্র করেছিলেন । আমাদের মনে রাখতে হবে কিভাবে চাঁদ কাজীর ফতোয়া অমান্য করে চৈতন্যদেবের নেতৃত্বে শতসহস্র গৌড়ীয় সন্তান শ্রীখোল বাজিয়ে সমগ্র নবদ্বীপের পথ কীর্ত্তনময় করে তোলে এবং কাজীকে নতিস্বীকারে বাধ্য করে । সেই গণবিপ্লব, সেই জনজোয়ার, ক্ষমতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা সাধারণ গৌড়ীয় জনগণের তীব্র জনরোষ - সেই বিপ্লবের রক্তস্রোত পুনরুজ্জীবিত করবার লক্ষ্যে আমরা সেই ‘নগরপরিক্রমা’ রীতিকেই পাথেয় করলাম।
গৌড়াধিপতি শশাঙ্কদেবের বংশধর এই বাঙ্গালী জাতির ধর্ম্ম-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই ‘নববর্ষ’ । আমাদের সকলের উচিত আলোচ্য শোভাযাত্রায় উপস্থিত থেকে সাংস্কৃতিক বাঙ্গালী জাতীয় ঐক্যের এই পুণ্যমুহূর্ত সঞ্চয়ন করা। গৌড়েশ্বর শশাঙ্কদেবের রাজ্যাভিষেকের পবিত্র দিবসে প্রত্যেক গৌড়ীয় বংশধর এই পুণ্য শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করুন।
Advertisement
Event Venue & Nearby Stays
Kolkata - The City of Joy, Kolkata, west bengal,Kolkata, India